মন ভাঙনের পাড়ে
শক্তি সামন্ত
ধারাবাহিক উপন্যাস Mon Vangoner Pare পর্ব ৪
[চার]
আজ বিকেলে মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে।উড়ো মেঘের
বৃষ্টি এমনই হয়।ওরা আড্ডা দিচ্ছিল উজান আরও ক-জন বটতলায়।
হঠ্যাৎ করে কথাটা বলেই বসল রুপক,
আজ বৃষ্টি আসুক জোরে ! যেন ডুবে যায় ও পাড়া।
কেউ ভেবে উঠতেই [ধারাবাহিক উপন্যাস Mon Vangoner Pare পর্ব 4 ]
পারেনি রূপক এই কথাটা বলতে পারবে।চিরকালই লাজুক স্বভাবের রূপক।
আসলে ব্যাপারটা হয়েছে যে,রূপক, উজান, পটলা আরও ক-জন আড্ডা
দিচ্ছিল বট তলায়।বাজার থেকে ফিরছিল সুনিতা। সুনিতা পাশের পাড়ার
মেয়ে রূপকের থেকে একটু ছোট হবে। হঠাৎ কখনও বৃষ্টি হয়ে
গেলে এই বট তলার রাস্তাটা একটু প্যাচপ্যাচে হয়ে যায়।জল জমে থাকে। সেদিন সুনিতার রাস্তা
পার হতে অসুবিধা হচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে বলেছিল,"ওহ এই জায়গাটা একেবারে
নরক।" ব্যাস, তার সেই বক্তব্য উজানদের খারাপ লেগেছিল।
যতই হোক, নিজের এলাকা নিজের পাড়া সম্মন্ধ্যে কে খারাপটি শুনতে চাই! তাই
স্বাভাবিক কারণেই উজানদেরও খারাপ লেগেছিল।যদিও সে সময়ে রূপক
উপস্থিত ছিল না। কিন্তু আজ যখন শুনল উজানের মুখে চট করে মাথায়
এসে গেল ,শুনিয়ে দিল কথা কটা।
[ধারাবাহিক উপন্যাস Mon Vangoner Pare পর্ব 4]
কিছু দূর গিয়ে ঘুরে দেখল সুনিতা,
হয়ত প্রথমটা বুঝতে পারেনি।পরক্ষনে চোখ দিয়ে চেখে নিল, কে বলল এই কথা!
খুব শান্ত দেখাচ্ছে সুনিতাকে আজ। মুখের উপর কথা বলে দেওয়া অভ্যাস, তার মতো
চটপটে স্বভাবের মেয়ে এ তল্লাটে আর কেউ নেই বললেই চলে ।হয়ত আজ এতগুলো
ছেলেকে একসাথে দেখে একটু ভয় পেয়েছে ।আবার মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।
তারপর থেকে সুনিতার সাথে রাস্তা-ঘাটে চোখাচোখি হলেই রূপকের মনে
কেমন একটা ভাললাগা অনুভূত হতে থাকে।ধীরে ধীরে রাগটা মন থেকে উবে গেল ,
আর নেই । এদিকে উজানের মুখে সুনিতার
সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে থাকে রূপক। আর মনের ভিতরে জমতে থাকে
সুনিতার প্রতি এক অমোঘ আকর্ষন।
বেশ কিছু দিন পর রূপক জানতে পারে ঋজু আর প্রাণেশের ক্লাসমেট সুনিতা। রূপকের
ভাললাগা এমন মাত্রায় পৌঁছল আর সামলানো যায় না।সারাক্ষণ শুধু একটা ছোট
লাল সাইকেল নিয়ে রোজ তার পিছু পিছু। ধীরে ধীরে রূপকের মনোভাব
সকলেই জেনে যায়। সুনিতা আর বান্ধবীদেরও বুঝতে বাকি রইল না
যে একটা ছেলে প্রায় তার পেছনে কেন ঘুরছে।ঋজু আর প্রাণেশ বিষয়টাকে বেশ
মশলাদার করে পাকিয়ে সুনিতার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করতে থাকল।
সন্ধ্যে নেমেছে সবে, রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। সুনিতা আর বান্ধবীরা
বাজার থেকে ফিরছে।নিয়ন আলোর মায়া ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বলের আকাশে বাতাসে।
সুনিতার মুখেও আজ কথার ফুলঝুড়ি ।তার পেছনে রূপক সাইকেল নিয়ে সুদীপদার
দোকানের দিকে। সুনিতারাও সুদীপদার দোকানে ঢুকল।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে তার
বান্ধবীরা। সুনিতা তাদের জন্যে চকলেট কিনতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
"এই কটা চকলেট নেব রে?" ঠিক এমন সময় রূপকও মাথা চুলকোতে চুলকোতে
সুদীপদার দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা সুনীলের সাথে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে।
আর মাঝে-মাঝে দেখছে সুনিতাকে ।
[ধারাবাহিক উপন্যাস Mon Vangoner Pare পর্ব 4]
রূপকের এমন ভাব ভঙ্গিমা দেখে
তার এক বান্ধবী বলে উঠল , "একটা বেশি নে। তোর স্পেশাল লোকের জন্যে।"
আর একজন বলল,"একটা শ্যাম্পু নে, ভালো তেল নে। মাথায় খুস্কি হয়েছে বুঝলি?"
সুনীল তাদের সেই ব্যাঙ্গাত্বক কথাবার্তা বুঝতে পেরে রূপককে জিজ্ঞেস
করল , কিরে ? কি ব্যাপার?"মাথার চুলে হাত বুলোতে ,বুলোতে রূপক
মুখ টিপে হাসছে।
ডান দিকের আধো আলো আর অন্ধকার রাস্তার মধ্যে সেদিনের মতো অদৃশ্য
হয়ে গেল সুনিতারা। রূপক আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এছাড়া আপাতত আর কিছুই
করার নেই । সন্ধ্যার হিম পড়ছে মাথার উপর ।
রূপক ভালমতো জানত এই বয়স তার ডুবে আছে এক আশ্চর্য মোহমায়ায়।
এ মোহমায়ার জাল কেটে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে মায়ার
আবেগ বুকের ভিতর প্রেমের রস সিঞ্চন করে আরও তরতাজা করে তুলে
তার হৃদয়।আর বুকের ভিতর বেড়ে উঠে ভালবাসা।
সুনিতার সাথে তার
ভালবাসার সম্পর্ক যেন সারা আকাশ জুড়ে আছে।যেন বহু যুগের বর্নিত
আলেখ্য।আকাশে বাতাসে গুঞ্জরিত হয় সে উপকথা।
সময় তার নিজস্ব নিয়মে গড়িয়ে চলল কিন্তু রূপকের ভালবাসার চাকা আর
বেশি দূর এগোয় না। হয়ত সুনিতার দিক থেকে দ্বিধা ছিল ।
আর রূপকের
ছিল নানারকম সামাজিক বাধা।কিন্তু প্রেম সে পরিণতি পেতে চায়।কোন বাধা
মানে না। সময় কাটতে থাকে এইভাবে।
ভীষণ শিত পড়েছে,সূর্য ডুবে গেছে একটু আগেই।হালকা কুয়াশা নিয়ে সন্ধ্যা
নেমেছে। রূপক একটা মাফলার মাথায় জড়িয়ে জড়োসড় হয়ে বসে আছে
সুদীপদার দোকানের পাশের বেঞ্চিতে।আজও আবার বাজার থেকে সুনিতা আর
বান্ধবীরা ফিরছে। রূপককে দেখতে পেয়ে বলে উঠল," বাবু !
খুব ঠাণ্ডা লেগেছে?
আহারে!"ভীষণ লজ্জ্বা পেয়ে যায় রূপক ,কিছুই বলতে পারে না। এতগুলো মেয়ে
একসাথে ,তারাও সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে হেসে উঠে ।বেশ আড়ষ্ট বোধ করছে সে ।
আসলে এই বয়সটাই হয় এমন একটুতেই ইমোশনাল
হয়ে পড়ে।
[ধারাবাহিক উপন্যাস Mon Vangoner Pare পর্ব 4]
তবে সুনিতারা চলে যাওয়ার পর রূপকের ভাল লাগে, এটা ভেবে যে তাহলে
সুনিতারও তার প্রতি ইন্টারেস্ট আছে বোধ হয়।মনের ভিতর যে আবেগের নদীটি বয়ে
যায় তিরতির করে ,আজ ঢেউ উঠেছে দারুণ , স্বপ্নের জোয়ার তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।
অনেক রাত পর্যন্ত সে এই সব কথায় ভাবতে থাকে ,এক কাব্যময় দুনিয়া তার ভিতর।
না, কাব্য করলে চলবে না । এই বার একটা চাকরি-বাকরি জোগাড় করতে হবে তাকে।
না হলে সুনিতা কেন! কোন মেয়েই তাকে পাত্তা দেবে না।বাবা বলেছে কিছু একটা ব্যাবসা
করতে কিন্তু সে রাজি নয়।তার খুব ইচ্ছে বিদেশ যাওয়ার।অবশ্য সেটাও ভাগ্যে
থাকা দরকার।আর এই মুহুর্ত্বে বিদেশ গেলে সুনিতাকে ভুলে যেতে হবে। বেশ উভয়
সঙ্কটে পড়েছে রূপক।
কয়েকদিন হল সুনিতাকে দেখতে পায়নি রূপক । ঋজু বলল, "কিরে মন খারাপ?"
যেন কিছুই নয় এমন ভাব করে রূপক হাসতে হাসতে বলল,"কেন? মন খারাপ
হতে যাবে কেন?"
"এই যে চুপ চাপ বসে আছিস।"
"এমনি।" বলে চুপ করে গেল।
ঋজু ব্যাঙ্গ করে বলল,"ওহ আমি ভাবলাম সুনিতার সাথে দেখা হয়নি তাই।"
রূপক চুপ করে বসে আছে কিছু বলছে না ,কিন্তু মনে মনে ভাবছে নিশ্চয়
ঋজু জানে সুনিতার ব্যাপার । এই ক-দিন তার সাথে দেখা হয়নি কেন? রূপক
অধীর আগ্রহে আছে। সে শুনতে চায়। জানতে চায়।
ঋজু আরও বলল,"কোলকাতায় তার বাবার কাছে ঘুরতে গেছে।চলে আসবে।"
রূপকের কিছুটা নিশ্চিন্ত লাগছে এইবার। সে জানে সুনিতার বাবা কোলকাতায় চাকরি করে।
কয়েকদিন পর রূপকের আবার দেখা হল সুনিতার সাথে। সুনিতা একা ছিল
স্কুল পথে । রূপকের মনে আনন্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। অজান্তেই গেয়ে উঠল,
"কত দিন পরে এলে ,একটু শোন,তোমায় অনেক কথা বলার ছিল যদিইই শোন!"
হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত গানটা পরিস্থিতি অনুযায়ি একটা শব্দ চেঞ্জ করে
গেয়ে উঠতেই প্রিয়তোষ, ঋজু , প্রাণেশরা হেসে উঠল।
সুনিতাও আর হাসি চেপে রাখতে পারল না । মুচকি হেসে ফিরে তাকাল।
রূপকের মনে তখন আবেগের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
আজ একটা প্র্যাকটিস ম্যাচ আছে বোধি এসেছে। বোধি টিমের অন্যতম ব্যাটসম্যান।
বোধি, ঋজু আর প্রাণেশের বন্ধু। সেই সূত্রে এবং ক্রিকেট খেলার সৌজন্যে রূপকের
সাথেও ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।আবার সুনিতাদের বাড়ির সাথেও বোধিদের
বাড়ির বিশেষ পরিচয় আছে।প্র্যাকটিসের মঝেই গল্প হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে।
হঠাৎকরেই সুনিতার কথা উঠল ।বোধি, ঋজুকে জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা! সুনিতার
এপাড়ার লোকেদের প্রতি এত রেগে থাকে কেন?"
ঋজু হাসতে হাসতে বোধির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল , "কেন কি বলেছে?
অবশ্য ওপাড়ার লোকেরা এ পাড়ার লোকেদের এমনিতেই বিশেষ পছন্দ করে না।
সেতো সবাই জানে।"
রূপক বলল ," কোন অজ্ঞ্যাত কারন আছে বুঝি!" হেসে উঠল।
বোধি এইবার রূপকের দিকে তাকিয়ে বলল,"সুনিতা বলেছে রূপক ছাড়া এপাড়ায়
একটাও ভদ্র ছেলে নেই।"
প্রাণেশ বলল, "তাই নাকিরে ? তাহলে,পটে গেছে? তোর আর কোনও চিন্তা নেই বুঝলি।
তোর প্রশংসা করছে মানে কিছুতো একটা ব্যাপার আছে!নিশ্চয় মনে ধরেছে তোকে।"
তার মজাকিয়া কথায় সবাই হাসছে । রূপকও মুচকি
মুচকি হাসছে দেখে ঋজু বলে উঠল, "বেটা! মনমে লাড্ডু ফুটা!"
[চলবে]
[কি হতে চলেছে রুপকের জীবনে ? সুনিতা কি বুঝবে
রুপকের মনের কথা ? জানতে হলে অবশ্যই পরর্বতী পর্ব পড়ুন]
*****************
Tags
উপন্যাস
