Best Romance Nobel Nibbhrita Chayachar
প্রতিদিন দুপুর হলেই কেমন যেন একটা, গা ছম-ছম করে। ইদানীং কেমন অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা ঘটে যাচ্ছে ঘরে। হঠাৎ করেই মাঝে মাঝে বিভিন্ন রকমের আওয়াজ তার কানে আসে। সে ছাড়াও যেন এই ভরদুপুরে আরও একজনের উপস্থিতি সে টের পায়। অথচ চোখে দেখে না কিছুই। আর এমন ঘটনা সব সময় হয়না। আবির বাড়িতে না থাকলেই এমন ঘটনার সম্মুখীন হয় মেঘনা। প্রথম, প্রথম ভাবতো এটা বুঝি তার মনের ভুল। কিন্তু এখন এই ক'দিন আরও বেশি করে ঘটছে এমন ঘটনা। যা এর আগে কখনো এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়নি সে।
কখনো বাসন পড়ে যাওয়ার আওয়াজ, আবার কখনো কারও ঘোরা-ফেরা করার পায়ের আওয়াজ,কখনো বা কারও ফিসফিস আওয়াজ ভেসে আসে মেঘনার কানে। এ যেন এক ভৌতিক কান্ড। ভুতের গল্প সে অনেক শুনেছে কিন্তু কখনো বিশ্বাস করেনা যে, ভুত বলে আদৌও পৃথিবীতে কিছু থাকতে পারে।
আবির অফিসে চলে যাওয়ার পর,দুপুরে সাধারণত মেঘনা একা একাই থাকে। বিয়ের পর মেঘনাকে যোধপুরের এই ভাড়া বাড়িতে এনে রেখেছে সে । বাড়িটা বেশ পুরনো বটে, তবে বসবাস করার পক্ষে ঠিকই আছে।তাছাড়া এতো কম ভাড়ায়, এতো কম সময়ে এমন একটা বাড়ি পাওয়াও খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। মেঘনারও মোটামুটি পছন্দ হয়েছিল ঘরটা। আগে যারা ছিল এ ঘরের দেওয়ালে তাদের রেখে যাওয়া ছাপ স্পষ্ট। বেলে পাথরের দেওয়াল মোটা করে চুন দিয়ে নীল রঙ করা। পাশাপাশি প্রায় সব ঘরগুলি একই রকম। প্রায় সব ঘরেই নীল রঙ।
আশেপাশে কারও সাথে তেমন পরিচিতি হয়ে উঠেনি এখনো তাদের। তাছাড়া ভাষা সংক্রান্ত একটা সমস্যাতো আছেই। হিন্দিতে কথা বলতে হয়। যদিও এই অঞ্চলের ভাষা মাড়োয়ারি তবে যেহেতু হিন্দি মাড়োয়ারি ভাষার মধ্যে মিল আছে অনেকখানিই। তাই,হিন্দিতেই অনায়াসে কথা বলে নেওয়া যায়। বিশেষ করে সব্জি ওয়ালা,দুধওয়ালা দের সাথে। সেভাবে তেমন কোন সমস্যা নেই মেঘনাদের।
সারাদিনের বেশিরভাগ সময়ই তাকে একলাই থাকতে হয় এখানে।মেঘনার জীবনে এই একাকিত্ব যেন ধীরে ধীরে তার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। আবিরের অনুপস্থিতিতে তার দিনের অধিকাংশ সময় কাটে ওই ছোট্ট ছয় ইঞ্চির স্মার্টফোনে। সেই স্মার্টফোনই যেন তার একমাত্র সঙ্গী,তার পৃথিবী। সকালে ঘুম থেকে উঠা থেকে রাত পর্যন্ত, ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামই তার জগতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটানো সময়গুলো তাকে কোনো না কোনোভাবে তার একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। তার উদাস জীবনের ব্যাথার মলম হিসাবে কাজ করে।
মেঘনার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল এখন জমজমাট। মাঝে মাঝে সে জনপ্রিয় গানের সাথে তাল মিলিয়ে নাচে, কখনো বা লিপ-সিং করে। এসবের ভিডিও সে রিলস হিসেবে আপলোড করে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। ধীরে ধীরে তার ফলোয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে, আর তার ভিডিওগুলোর লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের সংখ্যাও কম নয়।
নিভৃত ছায়াচর এক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের উপাখ্যান
ভিডিওগুলোর সাফল্যে মেঘনার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলে, যেন এক সেলিব্রিটির মতোই মনে হয়। এভাবে সে নিজের মধ্যে এক নতুন পরিচয় খুঁজে পায়—সে এখন নিজেকে একজন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার ভাবে। অন্যদিকে, আবিরের এসব ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ নেই। মেঘনার এসব শখ সে মোটেও পছন্দ করে না, বরং মাঝে মাঝে ব্যাঙ্গ করে কিছু কথা শুনিয়ে দেয়, আবার হেসেও উঠে, মজা করে।
এইসব করে কি হবে, তুমি কি মনে করো এভাবে কিছু হবে? আবির প্রায়ই এই প্রশ্নটা করে। মেঘনা অবশ্য এসব কথাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। তার কাছে, আবিরের এসব মন্তব্য শুধু কৌতুকের মতোই শোনায়। সে মনে করে, এই ভিডিওগুলো তার জীবনের এক ধরনের বিনোদন, যা তাকে তার একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেয়। সে খুশি হয়, তার ভালো লাগে,এক কথায় এটাই তার স্যাটিস্ফেকশন।
আবিরও জানে যে, মেঘনার এই শখ তাকে খুশি রাখে, আর তাই সে মেঘনাকে একদিন অবাক করে দিয়ে একটি ট্রিপড কিনে দেয়। অনলাইনে পছন্দ করে অর্ডার করেছিল। সেদিন খুব খুশি হয়ে ছিল মেঘনা। আবির ভেবেছিল, সারাদিন ঘরে বসে থাকা মেঘনা যেন কিছুটা সময় কাটাতে পারে। একা একা ঘরে বসে থেকে সে করবেটাই বা কি!
এই নিয়ে আবিরের মনে একটা চাপা দুঃখও আছে। তাদের বিয়েতে মেঘনার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। শেষমেশ সে রাজি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আবির জানে যে মেঘনার পক্ষে মন থেকে এই বিয়ে মেনে নেওয়া সহজ নয়। তাকে হয়তো খুব একটা পছন্দ করে না মেঘনা। আবির জানতে পেরেছিল কোন কারনে মেঘনা বাধ্য হয়েই বিয়েটা করেছিল। কিন্তু মেঘনার মতো একজন সুন্দরী স্মার্ট মেয়ে কেন বাধ্য হয়েছিল সে খবর জানে না। জানবার তেমন আগ্রহও ছিলনা আবিরের। একই পাড়ার মেয়ে মেঘনা তার প্রতি দূর্ববলতা ছিল অনেক দিনের। সে কারনেই এই বিষয়ে খুব বেশি মাথা ঘামিয়ে দেখেনি সে। আবির ভেবেছিল আজ নয় কাল, একদিন না একদিন মেঘনা তাকে ঠিকই মেনে নেবে, সম্মান দেবে তার ভালবাসাকে। আর সেই আশাতেই আবির মেঘনাকে একটু বেশিই গুরুত্ব দেয়, আপত্তি থাকা স্বত্বেও তার শখগুলোকে প্রশ্রয় দেয়। যাতে মেঘনা তার প্রতি না হলেও অন্তত সে নিজেই খুশু থাকে। সে মনে করে মেঘনার খুশিই তার খুশি। সে যে, ভালবাসে মেঘনাকে।হোক না সে ভালবাসা একতরফা। ভালবাসার জন্যে সব কিছুই করা যায়।
মেঘনা আবিরের এই আচরণে সন্তুষ্ট হলেও, তার একাকিত্বের যন্ত্রণা মাঝে মাঝেই তাকে গ্রাস করে। সে ভাবে, তার জীবনে কী যেন একটা নেই, যেন এক শূন্যতা। এই শূন্যতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই হয়তো সে নিজের মধ্যে এক সেলিব্রিটির ছায়া খুঁজে ফেরে, নিজের ভিডিওগুলোতে লাইক আর শেয়ারের সংখ্যা দেখে আনন্দ পায়। যত বেশি লাইক তত বেশি সে খুশি।
আবিরের প্রতি তার এই উদাসীনতা, আর তার মনের এই শূন্যতা ধীরে ধীরে তাকে আরও বেশি করে সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে টেনে নিয়ে যায়। মেঘনা জানে না, তার এই সোশ্যাল মিডিয়া জীবনের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক কতটা আলাদা। তবুও, সে এই ছয় ইঞ্চি স্ক্রিনের ভারচুয়াল দুনিয়ায় বাঁচার চেষ্টা করে, নিজের একাকিত্বকে ভুলে থাকার জন্যই হয়তো।
আজও, ট্রিপডের উপর মোবাইলের ক্যামেরাটা রেখে যেই একটা গানে নাচতে যাবে, ওমনি রান্না ঘরের বাসন গুলো ঢং ঢং করে পড়ে যায় তীক্ষ্ণ আওয়াজে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বিরক্ত হয়ে মেঘনা বেড়াল ভেবে ছুটে গেল সে দিকে। শাল্লা, আজ তোর শাস্তি আছে রোজ রোজ বাসন ওলটানো! একদিনও ধরা পরে না যে। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে বলতে কিচেনে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল মেঘনা। রোজকার মতো আজও নিরাশ হল সে।
না, কেউ কোথাও নেই। শুধু মেঝের উপর কয়খানা বাসন পড়ে আছে। একটা ছোট বাটি বনবন করে ঘুরছে তখনো। তীক্ষ্ণ আওয়াজটা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে হতে থেমে গেল। বুকটা ধড়াম করে উঠলো। এইবার গা ছম ছম করছে মেঘনার। (তারপর)
